মানুষ যে কারনে পরকীয়ায় জড়ায়

১. রিনা (ছদ্মনাম)। বয়স ৩৪। একদিন হঠাৎ করে স্বামীর মোবাইল ফোনে তাঁর অফিসের সহকর্মীর একটি খুদে বার্তা (এসএমএস) দেখতে পান। সেখানে বেশ ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কথা লেখা আছে। বিষয়টি স্বামীর কাছে জানতে চাইলে প্রথম দিকে অস্বীকার করলেও পরে ঘটনাটি স্বীকার করে নেন। জানান, একটি মেয়ের সঙ্গে বছর দুয়েক ধরে সম্পর্ক চলছে তাঁর। রিনা যেন আকাশ থেকে পড়েন। দম আটকে আসতে চায়। ভেতরটা যেন ক্ষতবিক্ষত হয়ে রক্তাক্ত হয়ে যায়। ভেবে কূল পান না, কী করবেন? স্বামীকে ছেড়ে চলে যাবেন, নাকি এত দিনের সংসার টিকিয়ে রাখতে মেনে নেবেন সবকিছু?

২. তাহমিনা (ছদ্মনাম)। বয়স ২৮। ঘরে একটি সন্তান। স্বামীর সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই পাঁচ বছর ধরে। শুরু থেকেই স্বামী একটু কেয়ারলেস ছিলেন। বহু চেষ্টার পরও স্বামী কোথায় আছেন, সেটি জানতে পারেন না তাহমিনা। জীবনযুদ্ধের এ লড়াইয়ে একপর্যায়ে তাঁর জীবনে আসেন আলম (ছদ্মনাম)। আলম বিবাহিত মধ্যবয়স্ক পুরুষ। আলমের কথা বলার ধরন, মানসিকভাবে সহযোগিতা করতে চাওয়ার কিছু বিষয় তাহমিনাকে এতটাই মুগ্ধ করে যে তিনিও তাঁর প্রতি তীব্র আকর্ষণ অনুভব করতে থাকেন। অনেক ঘনিষ্ঠ হওয়ার পর একসময় তাহমিনা চান আলমকে বিয়ে করতে। কিন্তু আলম তাঁর পজিশন আর স্ট্যাটাস থেকে সরে আসতে চান না। ভয় পেয়ে সরে যান তাহমিনার কাছ থেকে। তীব্র যন্ত্রণা আর অপমান নিয়ে তাহমিনা সরে আসেন আলমের কাছ থেকে। আলমকে তিনি ভালোবেসেছিলেন, আশ্রয় ভেবেছিলেন। ঘটনাটি সহ্য করা তাঁর জন্য এতটাই কষ্ট আর যন্ত্রণার হয়ে ওঠে যে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন।

সমাজে এ রকম অমীমাংসিত সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন কেউ কেউ। খুব তীব্র হয়ে গেলে এটি কষ্ট বাড়ায়, ভীষণভাবে চাপ ফেলে মনের ওপর। যদিও স্বেচ্ছায় দুজন নর-নারী এমন সম্পর্কে জড়ান, তারপরও সমাজে এটি পরিচিত পরকীয়া বা বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক নামে। কারণ, সমাজে এমন সম্পর্ক রীতিসম্মত নয়। তাই মেনে নেওয়া হয় না। মানুষ পরকীয়ায় কেন জড়ায়, তা নিয়ে কথা হলো কয়েকজন মনোবিদ ও মনোচিকিৎসকের সঙ্গে।

কেন জড়ায়
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের চাইল্ড অ্যাডোলসেন্ট ও ফ্যামিলি সাইকিয়াট্রি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, মনোদৈহিক ও সামাজিক কারণে মানুষ পরকীয়ায় জড়ায়। প্রথমে আসে দৈহিক বিষয়। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যৌন সম্পর্কে অতৃপ্তি থেকে অনেকে এ সম্পর্কে জড়ায়। সেক্স মানুষের একটি শরীরবৃত্তীয় চাহিদা। যদি স্বামী-স্ত্রীর যৌনজীবন দুর্বল হয়, তাহলে অপর ব্যক্তির প্রতি আসক্তি তৈরি হতে পারে।

কারো মধ্যে যদি ডিআরডিফোর জিনের উপস্থিতি বেশি হয়, তাঁদেরও পরকীয়া বা বাড়তি সম্পর্কে জড়ানোর প্রবণতা থাকতে পারে।
অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, অনেক সময় মানসিক সমস্যার কারণেও মানুষ পরকীয়ায় জড়াতে পারে। যাঁদের মধ্যে বাইপোলার মুড ডিজঅর্ডার আছে, তাঁদের পরকীয়ার সম্পর্কে জড়ানোর প্রবণতা দেখা যায়। তাঁরা কোনো কিছুর মধ্যে স্থিরতা খুঁজে পায় না।

সঙ্গীর উদাসীনতা ও দূরত্বের কারণেও অনেক সময় মানুষ পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়ে জানিয়ে তিনি বলেন, অনেক সময় স্বামী-স্ত্রী বাস্তবতার কারণে, কাজের কারণে হয়তো দূরে চলে যায়। তখন তাঁদের মধ্যে পরকীয়ার আগ্রহ বাড়ে। অনেক সময় পশ্চিমা সংস্কৃতির ধাঁচ নিজেদের মধ্যে আনতে চায়, তখন পরকীয়া বাড়ে। এ ছাড়া স্বামী-স্ত্রীর দ্বন্দ্ব, দূরত্ব ইত্যাদির জন্যও অন্যের প্রতি আগ্রহ, আসক্তির ঘটনা ঘটে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক তানজির আহম্মদ তুষার বলেন, প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে পরকীয়ার বিষয়টি চলে আসছে। উন্নয়ন ও মঙ্গলের কথা চিন্তা করে মানুষ একগামী। তবে মানুষ মূলত বহুগামী। পরকীয়াতে যেকোনো একজনকে বিবাহিত হতে হবে অথবা দুজনই বিবাহিত থাকতে পারেন।

মানুষ কেন পরকীয়ায় জড়ায়, এ বিষয়ে তানজির আহম্মদ বলেন, এক ধরনের প্রয়োজন বা চাহিদার কারণে মানুষ পরকীয়ায় জড়ায়। অনেক সময় শারীরিক প্রয়োজন থাকে। আর্থিক প্রয়োজন থাকে। স্ট্যাটাস বাড়ানোর জন্যও কেউ কেউ পরকীয়ায় জড়ায়। অনেক সময় মানসিক প্রয়োজন থাকে। আবার কিছু বিষয় শেয়ার করতে করতে অনেকে একসময় পরকীয়ায় জড়িয়ে যায়।

নির্ভরতা থেকেও পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়তে পারে জানিয়ে সাইকোলজিস্ট তানজির আহম্মদ বলেন, আবার অনেক সময় অবস্থার কারণেও হয়তো পরকীয়ায় জড়ায়। হতে পারে একসঙ্গে কোথাও বেড়াতে গেল। একপর্যায়ে হয়তো ভালো লেগে গেল। তখনও পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়ে। আবার দীর্ঘসময় একসঙ্গে কাটাতে কাটাতে, বন্ধুত্ব থেকেও অনেক সময় পরকীয়া হয়ে যায়।

অনেকে শখ থেকেও পরকীয়ায় জড়ায়। অন্য আরেকটি শরীর কেমন, একে জানার একটি আগ্রহ থাকে। অনেকে আবার ভাবে, ‘ওরা কি সুখী! এই মানুষটির সঙ্গে থাকতে পারলে হয়তো আমার অনেক সুখ লাগত।’ এ থেকেও অনেকে ওই ব্যক্তির প্রতি আগ্রহ অনুভব করে। অনেক সময় মিডিয়াও পরকীয়ার প্রবণতা তৈরি করে। বিভিন্ন ধরনের পর্নোসাইট দেখে পরকীয়ার প্রতি আগ্রহ তৈরি হতে পারে।

আসলে অধিকাংশ মানুষেরই একটি বাড়তি চাহিদা থাকে। তবে সামাজিক ও ধর্মীয় নিয়মনীতির কারণে এ সম্পর্কে জড়ায় না। অনেকে কিছু সুবিধা আদায়ের জন্য পরকীয়া করে জানিয়ে তিনি বলেন, হয়তো আর্থিক সাহায্য পাবে এ সম্পর্কে জড়ালে, এমন ভাবনা থেকেও কেউ কেউ পরকীয়ায় জড়ায়।

ক্রিয়ার মেন্টাল হেলথ ইউনিটের সাইকোলজিস্ট ইশরাত জাহান বীথি বলেন, পরকীয়ার পেছনে জড়ানোর একটি বড় কারণ হলো শূন্যতা। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যখন শূন্যতা তৈরি হয়, তখন আরেকজন সেখানে প্রবেশ করে। হয়তো স্বামী বা স্ত্রীর আর আগের মতো করে কথা বলে না বা আদর করে না। যত্ন কম নেয়। এই বিষয়গুলোর কারণে অন্যের প্রতি আসক্তি তৈরি হয়।

স্বামী-স্ত্রী দূরে থাকলেও এ সমস্যা হতে পারে। মেয়েদের বিয়ের আগে হয়তো যৌন চাহিদা তেমন থাকে না। বিয়ের পর তাঁরা বুঝতে পারে বিষয়টি। শুধু যৌনতায় অংশগ্রহণ নয়, কথাবার্তায়ও বিষয়টি থাকতে হয়। তখন যদি অন্য কেউ সেই কথাগুলো শোনায়, তাহলে তাঁর প্রতি আগ্রহ কাজ করে।

শারীরিক গঠন এ ব্যাপারে কাজ করতে পারে। কিছু কিছু ছেলে চিকন স্বাস্থ্যের মেয়ে পছন্দ করে। আবার কিছু কিছু ছেলে হয়তো একটু স্থূল স্বাস্থ্যের মেয়ে পছন্দ করে। সন্তান হওয়ার পর অনেক মেয়ে স্থূল হয়ে যায়। এতে স্ত্রীর প্রতি আগ্রহ কমে যেতে পারে। আবার নারীর বেলায়ও অনেকে হয়তো খুব হ্যান্ডসাম ছেলে পছন্দ করে, যা হয়তো তাঁর স্বামীর সঙ্গে মেলে না।

ন্যাশনাল ট্রমা কাউন্সেলিং সেন্টারের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট ইশরাত শারমীন রহমান বলেন, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ছোট ছোট চাওয়াগুলো হয়তো পূরণ হচ্ছে না। হয়তো স্ত্রী চাঁদ দেখতে পছন্দ করে, স্বামী সেটিকে বিলাসিতা মনে করে। এ রকম সময় অন্য কেউ যখন সেই জায়গায় আসে, তখন নির্ভরতা বেড়ে যায়। আবার অনেকে ভাবে, আমি তো একসঙ্গে দুটোকেই ব্যালান্স করছি। তাই আমি এমন একটি সম্পর্ক করতেই পারি।

আবার অনেকে মনে করেন, স্বামী বা স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও খুব ভালো একজন বন্ধু অথবা বান্ধবী থাকতে পারে। যার সঙ্গে মানসিক শেয়ারিং ও শারীরিক সম্পর্ক—দুটো বিষয়ই থাকতে পারে। এটা দোষের কিছু নয়। কারণ, বন্ধুত্বের সম্পর্কে কোনো প্রতিজ্ঞা নেই। যে কেউ যেকোনো সময় হয়তো এখান থেকে সরে আসতে পারে। একে অনেকে পরকীয়া বলে মনে করে না।

আবার অনেকে বিবাহবিচ্ছেদের পর বৈবাহিক সম্পর্কে জড়াতে চায় না। বিবাহিত কারো সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে নিজের চাওয়াগুলো পূর্ণ করতে চায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মানসিক ও শারীরিক প্রয়োজন মেটানোর বিষয়টিই এখানে মুখ্য হয়। এসব ভাবনা ব্যক্তিকে পরকীয়ার প্রতি আকৃষ্ট করে তোলে বলেই মনে করেন ইশরাত শারমীন রহমান।